কম বয়সে সন্তান ধারণ বাড়ায় মৃত্যুঝুঁকি

১৮ বছরের আগে বিয়ে ও অন্তঃসত্ত্বা হলে গর্ভপাতসহ প্রসবকালীন মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে। তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগও গর্ভবতীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ সময় তাদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। লিখেছেন রীতা ভৌমিক

কম বয়সে বিয়ে, অপুষ্টির শিকার মেয়েটির ১৭ বছর বয়সে গর্ভধারণ, আট মাসের গর্ভবতী অবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই। রীতা আক্তার নামে মেয়েটি নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে একজন অপুষ্ট সন্তানের জন্ম দেয়। স্বামী-শ্বশুরের জীবিকার তাগিদে নেত্রকোনা থেকে পরিবারের সঙ্গে সিলেট আসেন তিনি। ওর স্বামী, শ্বশুর যা রোজগার করে তা দিয়েই চলে তাদের আট সদস্যের সংসার। গত বছর জুনের মাঝামাঝিতে সকালে ওর স্বামী-শ্বশুর কাজে চলে যায়। বেলা বাড়তেই বন্যা ও ভারি বর্ষণে সিলেট শহরে শাহি ঈদগাহ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। গভীর ড্রেন ভরে পানি তীব্রগতিতে বস্তির ঘরগুলোতে ঢুকতে থাকে। শাশুড়ি, ছোট ননদ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যায়। কিন্তু ও ঘর থেকে বেরোনোর আগে কোমরপানি হয়ে যায়। ঘরে আটকা পড়ে যায় ও। কিছুক্ষণ পর শাশুড়ির খেয়াল হয় ছেলের বউ তাদের সঙ্গে নেই। খোঁজাখুঁজি শুরু হয়।

বস্তির কাছেই হুমায়রা আহমেদ জেবার বাড়ি। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করেন। তার বাড়িটা একটু উঁচু হওয়ায় বস্তির লোকেরা সেখানেই আশ্রয় নেয়। সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে হুমায়রা আহমেদ জেবা বলেন, গর্ভবতী মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে আমি এগিয়ে যাই বস্তির দিকে। একজন লোক তার

স্ত্রী-সন্তানকে আমাদের বাড়িতে রেখে আবার বস্তির ঘরে যান দলিলপত্র নিয়ে আসার জন্য। কোমরপানিতে মেয়েটি দাঁড়িয়ে কী করবে বুঝতে পারছিল না। আমার একার পক্ষে ওকে কোলে নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। লোকটির সহায়তায় ওকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসি। ঘরে এনে ওর ভেজা কাপড় বদলে দিই। ভয়ে ও কথা বলতে পারছিল না। হাত-পা সাদা হয়ে যায়। সেবা-শুশ্রূষা করে স্বাভাবিক করতে ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। ওকে খাইয়ে-দাইয়ে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি। পরদিন পানি নেমে যায়। ওর শ্বশুর-শাশুড়ি ওকে ঘরে নিয়ে যেতে চাইলে ও যেতে চায় না। ও ট্রমার মধ্যে চলে গিয়েছিল। এ ঘটনায় ওর শারীরিক-মানসিক চাপ পড়ে। যা ওর সন্তানের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

রীতা আক্তার বলেন, আমি ঘরে যেতে ভয় পাচ্ছিলাম। প্রচণ্ড বেগে বৃষ্টি হচ্ছিল। যদি আবার ঘরে পানি ঢুকে যায়। আমি তো দৌড়ে বের হতে পারব না। আমার সন্তানের কী হবে। সবার কথায় ঘরে এলেও ভয়ে ভয়ে থাকি। ৯ মাস পড়তেই প্রচণ্ড ব্যথা ওঠে, ব্লিডিং হয়, পানি ভাঙে। গরিব মানুষ, টাকাপয়সা নেই। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। জেবা আপাকে খবর দিই। জেবা আপা ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করায়। কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা না পাওয়ায় আমাকে মাতৃমঙ্গল ক্লিনিকে নিয়ে যায়। ডাক্তাররা সিজার করার কথা বলে। জেবা আপা টাকা জোগাড় করে অপারেশনের খরচ দেয়। কম ওজনের শিশু হওয়ায় বাচ্চাকে অক্সিজেন দিতে হয়। মেয়ের বয়স এখন আট মাস। মেয়ে সুস্থ হলেও আমার শরীর ভালো যায় না। দুর্বল অনুভব করি।

২০২১-এর জুন থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ‘মনিটরিং দ্য ইমপ্লিমেন্টেশন অব এসডিজিস ফর এনশিওরিং গার্লস অ্যান্ড চাইল্ড রাইটস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক জরিপে জানা যায়, সর্বনিম্ন আয়ের পরিবারে (মাসিক ২৫০০ টাকা) ১৮ বছর বয়সের আগে গর্ভধারণের হার সবচেয়ে বেশি (৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ)। জরিপে অংশগ্রহণকারী নারীদের ৩৫ দশমিক ৮ শতাংশই জানান, তারা ১৮ বছর বয়সের আগেই গর্ভধারণ করেন, এর হার রংপুরে সর্বোচ্চ (৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ)। জরিপে আরও দেখা যায়, অংশগ্রহণকারীদের (১৪-৪৯ বছর বয়সী নারী) ৯৩ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত এবং ৭৮ দশমিক ৪ শতাংশ তা অনুসরণ করেন। ৬৯ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবারে পুরুষ এবং নারী সদস্য একত্রে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেন। এ পদ্ধতি সম্পর্কে তারা তথ্য পান মূলত টেলিভিশন (৫৩ দশমিক ৭ শতাংশ), কমিউনিটি ওয়ার্কার (৩৩ দশমিক ২ শতাংশ) এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম (২৯ দশমিক ৫ শতাংশ) থেকে।

বারডেম জেনারেল হাসপাতালের গাইনি ও অবসের অধ্যাপক সামছাদ জাহান শেলী জানান, প্রত্যেক মেয়েকে পরিণত বয়সে বিয়ে ও সন্তান নিতে হবে। অপরিণত বয়সে প্রজনন অঙ্গের বিকাশ সম্পূর্ণ হয় না। তাই অপরিণত বয়সে মা হলে ত্রুটিপূর্ণ শিশু জন্ম হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া শরীরকে তৈরি না করে সন্তান নিলে কম ওজন, অপুষ্টি, গঠনগত প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমনকি গর্ভপাতও হতে পারে। অন্যদিকে গর্ভকালে গর্ভবতী মা পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার না খেলে ভ্রূণের গঠনগত বিকলাঙ্গ দেখা দেয়। আবার মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত হয়। ফলে শিশু বিকলাঙ্গ অথবা প্রতিবন্ধী হয়। তাই গর্ভধারণের আগে অপুষ্টি রোধে পুষ্টিকর খাবার খেয়ে রক্তশূন্যতা পূরণ করতে হবে। সন্তান ধারণের শুরু থেকেই প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম খেতে হবে। ভ্যাকসিন রুবেলা নিতে হবে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রকল্প ব্যবস্থাপক (কৈশোরকালীন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য), এমসিএইচ ইউনিটের ডা. মনজুর হোসেন বলেন, কিশোর-কিশোরীদের উন্নয়নে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। সবার স্বাস্থ্য উন্নয়ন কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। সব সংস্থার সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাদের একত্রে কাজ করতে হবে। বাল্যবিয়ে এবং কৈশোরকালে গর্ভধারণের হার কমাতে আমাদের কাজ করতে হবে। এ জন্য জন্মনিবন্ধনের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।