ন্যূনতম ভূমিকা নেই অধিকাংশের

রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে ১৯৭২-এর সংবিধানে জাতীয় সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা রাখা হয়। প্রথম সংসদে সংরক্ষিত আসন ছিল ১৫টি। এরপর বিভিন্ন সময়ে ৪ দফা বৃদ্ধির পর বর্তমানে এই সংখ্যা ৫০-এ দাঁড়িয়েছে

নিয়মিত হাজির থাকলেও দলীয় সিদ্ধান্তে ভোট দেওয়া ছাড়া সংরক্ষিত নারী আসনের বেশিরভাগ সদস্য জাতীয় সংসদে আর কোনো কাজে সক্রিয় থাকেন না। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আলোচনা, বিল উত্থাপন, আইন প্রণয়ন এবং জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে তাদের ভূমিকা নেই বললেই চলে। একাদশ জাতীয় সংসদের সার্বিক কার্যক্রম পর্যালোচনায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। মনোনয়নের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত যোগ্যতা, দক্ষতা ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা প্রাধান্য না পাওয়ার কারণেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে ১৯৭২-এর সংবিধানে জাতীয় সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা রাখা হয়। প্রথম সংসদে সংরক্ষিত আসন ছিল ১৫টি। এরপর বিভিন্ন সময়ে ৪ দফা বৃদ্ধির পর বর্তমানে এই সংখ্যা ৫০-এ দাঁড়িয়েছে। তবে জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণী বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সংসদীয় কাজে বেশিরভাগ নারী সদস্যেরই সক্রিয় ভূমিকা থাকে না। জাতীয় সংসদে সদস্যরা সবচেয়ে বেশি বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পান রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাব ও বাজেট আলোচনায়। কিন্তু নারী সদস্যের অনেকে এই দুটি ক্ষেত্রেও আলোচনায় অংশ নেন না। একাদশ সংসদের সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সুলতানা নাদিরা, উম্মে কুলসুম স্মৃতি, রাবেয়া আলীম ও রুশেমা বেগম, জাতীয় পার্টির নাসরিন জাহান রত্না ও শেরীফা কাদের এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলাম একবারও রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর বক্তৃতা দেননি। আর বাজেট আলোচনায় একবারও অংশ নেননি ফেরদৌসী ইসলাম, আঞ্জুম সুলতানা, সৈয়দা রাশেদা বেগম, অধ্যাপিকা মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী ও সেলিনা ইসলাম। একাদশ সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনার রেকর্ড বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে প্রথম অধিবেশনে মোট আলোচনা হয়েছে ১ হাজার ৮২৫  মিনিট। এর মধ্যে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যরা ২৮৭ মিনিট বক্তব্য দেন। দ্বিতীয় অধিবেশনেও ভাষণ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি। এর ওপর ১৯৮ মিনিট আলোচনা করেন সংসদ সদস্যরা। তার মধ্যে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যরা মাত্র  ৪ মিনিট বক্তব্য দেন। ২০২০ সালে ষষ্ঠ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ সম্পর্কে আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর ২ হাজার ৬৭৩ মিনিটের মধ্যে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যরা ৩৫৮ মিনিট বক্তব্য দেন। ওই সংসদের সপ্তম অধিবেশনে সংরক্ষিত নারী সদস্যরা কোনো বক্তব্যই দেননি। এ ছাড়া একাদশ অধিবেশনে ১ হাজার ৭৯ মিনিটের মধ্যে ২২৮ মিনিট, পঞ্চদশ অধিবেশনের ২৪২ মিনিটের মধ্যে ৬ মিনিট, ১৬তম অধিবেশনে ৫১৮ মিনিটের মধ্যে ৯৭ মিনিট, ১৭তম অধিবেশনে ১৬০ মিনিটের মধ্যে ১২ মিনিট এবং ২০তম অধিবেশনে ৮৫ মিনিটের মধ্যে ৭ মিনিট বক্তব্য দেন নারী সদস্যরা। একাদশ জাতীয় সংসদের চারটি বাজেট অধিবেশনগুলোর কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের ওপর ৩ হাজার ৩১৮ মিনিট আলোচনার মধ্যে সংরক্ষিত নারী সদস্যরা ৪৯২ মিনিট বক্তব্য দেন। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের ওপর আলোচনা হয় ২০৮ মিনিট। এর মধ্যে নারী সদস্যরা মাত্র ১৯ মিনিট বক্তব্য দেন। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের ওপর ৬১৮ মিনিট আলোচনা হয়। এতে নারী সদস্যরা বক্তৃতা দেন ১২৩ মিনিট। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের ওপর ২ হাজার ৩৬ মিনিটের মধ্যে নারী সদস্যরা আলোচনা করেন ২৮২ মিনিট। মুজিববর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালের নভেম্বরে বসেছিল সংসদের বিশেষ অধিবেশন। চার দিনের সেই অধিবেশনে সংসদ সদস্যরা মোট ৯০২ মিনিট আলোচনা করেন। এতে ছয় নারী সদস্য অংশ নিয়ে ৫০ মিনিট বক্তৃতা দেন। একাদশ সংসদের প্রথম থেকে ২০তম অধিবেশনের কার্যবিবরণী থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছরে নারী সদস্যরা ৭১ক বিধির (১) উপ-বিধি অনুযায়ী জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ৬২টি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। আর ৭১ বিধিতে গৃহীত মনোযোগ আকর্ষণী নোটিশের ওপর আলোচনায় অংশ নেন মাত্র চারজন। সংসদের পুরো মেয়াদকালে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বক্তব্য দিয়েছেন মাত্র চার জন। তারা হলেন নাহিদ ইজাহার খান, রুমিন ফারহানা, লুৎফুন নেসা খান ও সুবর্ণা মুস্তাফা। বেসরকারি বিল উত্থাপনের ক্ষেত্রে আরও পিছিয়ে নারী সদস্যরা। সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য বেগম ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরা সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দুটি বিল উত্থাপন করেন। আর বিএনপির রুমিন ফারহানা এবং জাতীয় পার্টির রওশন আরা মান্নান একটি করে বেসরকারি বিল উত্থাপন করেন। ষষ্ঠ অধিবেশনে সৈয়দা রুবিনা আক্তার ছাড়া আর কোনো নারী সদস্য পুরো মেয়াদে বেসরকারি সদস্যদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের ওপর বক্তব্য দেননি। একাদশ সংসদে ১৪৭ বিধিতে মোট ৫ বার সাধারণ প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এসব প্রস্তাবের ওপর মোট আলোচনা হয়েছে ১ হাজার ৪৭৫ মিনিট। এর মধ্যে নারী আসনের সদস্যরা আলোচনা করেছেন মাত্র ৮৯ মিনিট। সংসদে নারী সদস্যদের ভূমিকা সম্পর্কে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য আরমা দত্ত কালবেলাকে বলেন, ‘নারীদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে—বিশেষ করে সংসদ একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, সেটা নির্বাচিত বা সংরক্ষিত আসনে হোক। আমরা যেহেতু সংরক্ষিত আসনের, আমাদের কিছুটা বাধা রয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যরা কাজ করেছেন, করছেন।’ বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, ‘সংসদ সদস্য হিসেবে কে ভূমিকা রাখবেন আর কে রাখবেন না—সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। দু-একজন পুরুষ সংসদ সদস্যের নাম বলতে পারি, যারা সংসদে দাঁড়িয়ে কোনো কথা ঠিকমতো বলেননি। এটা শুধু নারী সংসদ সদস্যদের ঘাড়ে দোষ চাপালে হবে না, এটা প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব পছন্দ, তিনি কীভাবে নিজেকে সংসদে প্রতিষ্ঠিত করবেন।’ সংসদে নারী সদস্যদের ভূমিকা সম্পর্কে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘সংরক্ষিত নারী আসনে যারা নির্বাচিত হয়েছেন, সংসদে তারা সেভাবে ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। একজন সংসদ সদস্যের যে অধিকার সেটা তারা পান না। কাজের ক্ষেত্রে সংসদের যে দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, সেখানে তাদের সুযোগ খুবই সীমিত। সংরক্ষিত নারী আসনে যারা রয়েছেন তারা লক্ষণীয় ভূমিকা রাখতে পারছেন না। হয়তো তাদের মধ্যে দু-একজন সংসদ সদস্য রয়েছেন, যারা সংসদের ভেতরে ভূমিকা রাখতে না পারলেও নিজ উদ্যোগে জনকল্যাণমূলক, সামাজিক, রাজনৈতিক কাজে জনপ্রতিনিধি হিসেবে অবদান রাখছেন।’