সচেতনতাই পারে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে

This story first appeared in Kalbela

১৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেশি। স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে যাপিত জীবনে আনতে হবে পরিবর্তন। লিখেছেন রীতা ভৌমিক।

স্তন ক্যান্সারে নারীর মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। সাধারণত ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। শুধু নারী নয়, পুরুষও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন।

জনসংখ্যা অনুযায়ী, আমাদের দেশে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা নিবন্ধিত নেই। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে কতজন মারা গেছে এর সংখ্যাও নেই। বাংলাদেশে নতুন করে দেড় লাখের মতো মানুষ প্রতিবছর নানারকম ক্যান্সারে মারা যায়। ১ লাখ ৯ হাজার মানুষ প্রতিবছর ক্যান্সারে মারা যায়। এর মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। মারা যায় প্রায় ৮ হাজার। তবে শুরুতে শনাক্ত হলে ৯০ শতাংশ ক্যান্সার রোগী সুস্থ হতে পারে।

কেস স্টাডি-১

অনিকা (আসল নাম নয়) দুই সন্তানের মা। বড় ছেলের বয়স ১৪ আর মেয়ের ১০ বছর। বিয়ের ১৬ বছর পর ওর স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে।

অনিকা (৩৮) বলছিলেন, ২০২০ সালের দিকে ডান পাশের স্তনে হালকা ব্যথা হতো। প্রথমে বুঝতে পারিনি। কারণ স্তনে কোনো চাকা হয়নি। ২০২১ সালের দিকে এক মাস প্রচণ্ড ব্যথা হয়। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে গাইনি চিকিৎসক দেখাই। তিনি স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসক দেখানোর পরামর্শ দেন। চিকিৎসক স্ক্রিনিং করতে দেন। স্ক্রিনিংয়ে ধরা পড়ে ক্যান্সার। শেষপর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ডান দিকের স্তন ওই বছর ডিসেম্বরে অপারেশন করে ফেলে দেওয়া হয়। ২০ দিন পরপর আটটি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। এখন আর কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছে না। তবে নিয়মিত চেকআপে রয়েছি। শরীর ব্যথা করে। অসুস্থ অনুভব করি। তিন মাস পরপর চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখেন কোন পর্যায়ে রয়েছে।

কেস স্টাডি-২

অনেক দিন ধরে বাম স্তনে ছোট্ট একটা চাকা অনুভব করছিলেন সেঁজুতি। কিন্তু কোনো ব্যথা ছিল না। ভয়ে দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে দিন কাটছিল তার। সেঁজুতি বললেন, এখানকার চিকিৎসকের কাছে যেতে ভয় পাচ্ছিলাম। কী না কী আমাকে শোনাবে। একমাত্র ছেলের বয়স তখন সাত বছর। ভারতের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে সেখানকার চিকিৎসক দেখানোর পরামর্শ দেন। অবশেষে সেখানে চিকিৎসক দেখানোর সিদ্ধান্ত নিই। তিনি সব ব্যবস্থা করে দেন। চিকিৎসক আমাকে কয়েকটি পরীক্ষা দেন। সেইসঙ্গে স্ক্রিনিং করাতে দেন। স্ক্রিনিংয়ে ফাইবার ধরা পড়ে। ক্যান্সার নয়, রিপোর্টটি হাতে পেতেই এতদিনের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেলাম। যেন একটি নতুন জীবন পেলাম।

কেস স্টাডি-৩

মাত্র ৩২ বছর বয়সে স্তন ক্যান্সারে মারা যান উম্মে যারহা দিনা। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ২০১২ সালে তার স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে। বগলের নিচে টিউমার দেখা দিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি ও অবস বিভাগের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। চিকিৎসকের পরামর্শে বায়োপসি করান। পরীক্ষায় ডান স্তনে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর ডান স্তন অপারেশন করে ফেলে দেওয়া হয়। কেমোথেরাপি, রেডিয়েশনসহ বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা চলে। চিকিৎসায় ১৫-১৬ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। চার বছর ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে ২০১৬ সালের ২০ এপ্রিল মারা যান।

স্তন ক্যান্সার কেন ছড়ায়

স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে কিছু কিছু জিনগত পরিব্যক্তি অনেক সময় দায়ী হয়। এমনকি সারা বিশ্বের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৫ থেকে ১০ শতাংশ স্তন ক্যান্সার জিনগত পরিব্যক্তির কারণেই হয়ে থাকে।

বিশেষজ্ঞরা যা বললেন

পরিবারের একজন পুরুষেরও দায়িত্ব

ডা. হালিদা হানুম আখতার, স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ফ্যাক্যাল্টি, জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়

বছরে ১৫ হাজার মা মারা যান সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে। মায়েরা বুকের দুধ খাইয়ে বাচ্চাকে মানুষ করেন। কিন্তু এর মূল্য আমরা দিতে পারি না। আমরা যে পর্যন্ত একজন নারীকে মূল্য না দেব, সে পর্যন্ত তাকে সেবার আওতায় আনতে পারব না। প্রতি পাঁচ হাজারে একজন নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। একটি পরিবারে একজন কিশোরী, স্ত্রী, মা বা শাশুড়ি থাকে। তিন বয়সী নারীদের মধ্যেই স্তন ক্যান্সার হতে পারে। মানে এর প্রকোপ অনেক বেশি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞান খুব কম। সচেতনতা কম। কার ক্যান্সার হতে পারে, কার হতে পারে না, কী করলে ক্যান্সার কম হবে—এ জ্ঞানগুলো তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া, এটা একটি কঠিন ব্যাপার। আমরা মনে করি, ক্যান্সার হয়ে গেলে আর বাঁচার উপায় নেই। সবাইকে বুঝতে হবে ক্যান্সার কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য। সময়মতো সেবা নিতে পারলে, নিজেকে ভালোবাসতে শিখলে, সুস্থ থাকলেই আমরা অনেকাংশে এটাকে কমিয়ে নিয়ে আসতে পারব।

এ ক্ষেত্রে আমাদের সবার দায়িত্ব রয়েছে, একটা স্লোগান দিতে হবে, তোমার ঘরের নারীকে তোমরা বাঁচাও। এটা পরিবারের একজন পুরুষেরও দায়িত্ব, তার পরিবারের নারীর স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কারণ তিনিই পারেন তার মা, স্ত্রী, কন্যা, বোনকে স্তন ক্যান্সার থেকে বাঁচাতে।

বিকেন্দ্রীকরণ করা

অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার

অবসরপ্রাপ্ত, ইপিডেমিওলোজি বিভাগ

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

নারীর সংকোচবোধের কারণে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। একটু সচেতন হলেই এ আক্রান্তের সংখ্যা কমে যেতে পারে। এজন্য দরকার স্তন ক্যান্সার নির্ণয় ও স্ক্রিনিং (যাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ এখনো দেখা যায়নি)। যদিও বাংলাদেশে

স্তন ক্যান্সার চিকিৎসা অপ্রতুল। আমাদের দেশে স্তন ক্যান্সার

প্রতিরোধে সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ, পরিকল্পনা, কর্মসূচি নেই। তবে স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রায় ৯০ শতাংশ রোগী সুস্থ হতে পারেন। কিন্তু তৃতীয়, চতুর্থ, শেষ পর্যায়ে গিয়ে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এর ফলে আক্রান্তের অর্ধেকেরও বেশি রোগী মারা যাচ্ছেন।

স্ক্রিনিংয়ের সুবিধা তৃণমূলের, প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের জন্য বিস্তৃত করতে হবে। কারণ দেশের স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসাসেবা এখনো রাজধানীকেন্দ্রিক, উপশহরকেন্দ্রিক। আমাদের উচিত এটাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা। এ ক্ষেত্রে সরকার একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। আটটি বিভাগে আটটি ক্যান্সার হাসপাতাল হবে।

পাঠ্যসূচিতে তুলে ধরতে হবে

ডা. আবু জামিল ফয়সাল

জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

স্বাস্থ্যের কথা বলার পাশাপাশি ক্যান্সার প্রতিরোধের কথাও বলতে হবে। স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধের কথা সেভাবে বলা হয় না। এজন্য প্রতিরোধের কথা প্রচার করতে হবে। কারণ অজ্ঞতার জন্য আমরা অনেকে এ রোগে আক্রান্ত হই। সুস্থতার জন্য ভালো খাবারের সঙ্গে সঙ্গে আরও কী করা উচিত, তা আমাদের অনেকেরই জানা নেই।

এজন্য পাঠ্যসূচিতে স্তন ক্যান্সার কীভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব তা তুলে

ধরতে হবে।

ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি একটি তহবিল গঠন করে, তাহলে দরিদ্র রোগীর ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যয় কিছুটা বহন করা সম্ভব। তহবিল গঠনের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে

তাহমিনা গাফ্ফার

সভাপতি

অপরাজিতা সোসাইটি এগেইনস্ট ক্যান্সার

ব্যাংককে ২০০৩ সালে থরো চেকআপ করাতে গিয়ে ম্যামোগ্রাফিতে আমার ডান স্তনে ক্যান্সার ধরা পড়ে। ভারতের বোম্বের টাটা হাসপাতালে অপারেশন করা হয়। কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। এখনো দু-তিন বছর পরপর চেকআপ করি। সুচিকিৎসার ফলে এখনো সুস্থ জীবনযাপন করছি। সঠিক সময়ে

সঠিক চিকিৎসা পেলে দ্রুত এ রোগ নিরাময় হওয়া সম্ভব। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমি।

স্তন ক্যান্সার থেকে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আমরা কয়েকজন মিলে গড়ি তুলি অপরাজিতা সোসাইটি এগেইনস্ট ক্যান্সার নামে একটি সংগঠন। যারা ক্যান্সারকে পরাজিত করতে পারেনি, তাদের পরিবারের স্বজনরাও আমাদের এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। সবাই একসঙ্গে স্কুল, কলেজ, গার্মেন্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে নারী ও মেয়েদের স্তন ক্যান্সারবিষয়ক সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছি। প্রতি মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে একবার নিজের স্তন কীভাবে নিজে পরীক্ষা করতে হবে তা হাতে-কলমে শেখানো হয়। সে সময় যদি স্তনে কোনো গোটা বা চাকা হাতের স্পর্শে অনুভব করে, সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। মানসিক সহায়তা দেওয়ার জন্য তাদের পাশে দাঁড়াই।

চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া

সোনালি মুখার্জি

কনসালট্যান্ট, সরোজ গুপ্ত ক্যান্সার সেন্টার অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ঠাকুরপুকুর, ভারত

স্তনে ব্যথা অনুভব করলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। প্রথমে আলট্রাসনোগ্রাফি, মেমোগ্রাফি, সিটি স্ক্যান, এমআরআই করা। এরপর সিটি স্ক্যান বা আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে বায়োপসি করা। বায়োপসির রেজাল্টের ভিত্তিতে অপারেশন করতে হবে কি হবে না, তা নির্ধারণ করা। তবে বায়োপসিতে ক্যান্সার ধরা পড়লে অপারেশন করার পর্যায়ে থাকলে দ্রুত তা করতে হবে। অপারেশনের পর একজন বিশেষজ্ঞ সিদ্ধান্ত নেবেন রেডিওথেরাপি নাকি কেমোথেরাপি দেওয়া দরকার। কিংবা দুটোরই দরকার রয়েছে।

স্তনে সিস্ট ধরা পড়লে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসাসেবা নিলে দ্রুত

নিরাময় সম্ভব। সব সিস্ট থেকে ক্যান্সার না হলেও, কখনো কখনো হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

প্রথম অবস্থায় স্ক্রিনিং করা

অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী

সাবেক পরিচালক ও স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখক বারডেম

ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। আমরা ক্যান্সার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি মেশিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছি। ক্যান্সার আসলে রেডিওথেরাপি নয়। ক্যান্সার চিকিৎসায় ইমিউনোথেরাপি, কেমোথেরাপি, কার্টিসিয়াল থেরাপি রয়েছে। নতুন নতুন ওষুধ বের হয়েছে। ক্যান্সারের ব্যাপারে বিশ্বে অগ্রগতি হলেও আমাদের দেশে সেরকম অগ্রগতি নেই। যারা ক্যান্সারের ঝুঁকিতে রয়েছেন তাদের উপসর্গ শুরু হওয়ার আগে স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে ক্যান্সার শনাক্ত করা গেলে মৃত্যুঝুঁকি কমে আসবে। অর্থাৎ প্রথম অবস্থায় স্ক্রিনিং করলে ৯০ শতাংশই সুস্থ থাকতে পারে।

কুসংস্কারও রয়েছে আমাদের সমাজে। যে মায়ের বুকের দুধ খেয়ে

সন্তান বড় হলো, সেই মায়ের স্তন ক্যান্সার হতে পারে, সেটা ধারণা করতে পারে না। স্বামী তার স্ত্রীর স্তনের পরিবর্তন দেখে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন।

Link to original story