তিন ডজন আলোচিত প্রার্থীর পরাজয় যেসব কারণে

This story first appeared in Prothomalo

আলোচনায় থাকলেও সরকারদলীয় বা জোটের গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত প্রায় তিন ডজন ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থী নির্বাচনে জিততে পারেননি। আর এ পরাজয় নিয়ে সরকার, সরকারি দল, মাঠের রাজনীতি এবং ভোটারদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।

অনেকটা একতরফা নির্বাচন হলেও দলের প্রতিপক্ষ বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে তাঁদের হেরে যাওয়ার বিষয়টি নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। কেউবা বিস্মিত হয়েছেন, কারও কারও হিসাব মিলছে না।

সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে বিরোধী দল ছাড়া ‘হেভিওয়েট’দের পরাজয়ের বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। আবার কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীর হেরে যাওয়া সরকারেরই একটি কৌশল। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বোঝাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীকে হারানো হয়েছে।

তবে স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেছে, বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী নিজেদের জয়ের ব্যাপারে অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। কারণ, বারবার প্রশাসনের সহযোগিতা পেয়ে আসছিলেন তাঁরা। তাঁদের কেউ কেউ ছিলেন গণবিচ্ছিন্ন।

তবে সরকারদলীয় শীর্ষ একাধিক নেতা বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে নির্দেশনা ছিল। সে কারণে আইনশৃঙ্খলা বা নিরাপত্তায় জড়িত কোনো বাহিনী অথবা সংস্থার পক্ষ থেকে নির্বাচনের মাঠে প্রভাব বিস্তার করা বেশ কঠিন ছিল। তাঁরা বলছেন, নির্বাচনের আগে প্রায় ৩০ জন জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনা পুলিশ ও প্রশাসনকে নির্বাচনের দায়িত্ব পালন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।

নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছেন কিন্তু হেরে গেছেন, এমন পরিচিত নেতাদের মধ্যে আছেন বিগত সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য।

এনামুর রহমান

সাভার-আশুলিয়া আসনে নৌকার প্রার্থী ছিলেন টানা দুবারের সংসদ সদস্য এবং ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। সরকারদলীয় স্থানীয় একাধিক নেতা জানিয়েছেন, তিনি নিজের জয়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। এর পাশাপাশি জনবিচ্ছিন্নতা এবারের নির্বাচনে তাঁর পরাজয়ের অন্যতম কারণ। সাভার ও আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের দূরত্ব তৈরি হওয়ায় তিনি ভোটের মাঠে অনেকটা কোণঠাসা অবস্থায় ছিলেন। ব্যক্তিগত আচার-ব্যবহার এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে।

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্যছবি: সংগৃহীত

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণ তহবিলের সহায়তার চেক আটকে রাখার অভিযোগ ছিল। যশোরের পুলিশ সুপার (এসপি) প্রলয় কুমার জোয়ারদার স্বপন ভট্টাচার্যের জামাতা হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে নির্বাচন কমিশনে জেলার ছয় আসনের জাতীয় পার্টির ছয় প্রার্থী অভিযোগ জানান। প্রতিমন্ত্রীর ছেলে ও ভাগনে উপজেলার একজন জনপ্রতিনিধির নেতৃত্বে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীফাইল ছবি

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হকের (সুমন) কাছে হেরে গেছেন। এ আসনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের পরিচিত মুখ সৈয়দ সায়েদুল হক আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন, না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুজন প্রার্থী হওয়ায় দলের নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েন। পাশাপাশি চা-বাগানের ভোটাররা এবার নৌকার প্রার্থী থেকে দূরে সরে যান। ব্যারিস্টার সুমন চা-শ্রমিকদের ভোটের পাশাপাশি এলাকার তরুণ সমাজ ও নতুন ভোটারদের সমর্থন পান। মন্ত্রী হওয়ার পর এলাকায় মাহবুব আলীর যাতায়াত কমে যায়, এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন ব্যারিষ্টার সুমন।

মো. আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ)।ছবি: প্রথম আলো

এবার যাঁর হারে সবাই বিস্মিত হয়েছেন তিনি হচ্ছেন মো. আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ)। তিনি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মাদারীপুর-৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদ পান। তিনি দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদকও ছিলেন। তাঁর পরাজয় নিজ এলাকা তো বটেই, দলের ভেতরে ও বাইরে অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। মাদারীপুর জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, নেতা–কর্মীদের অবমূল্যায়ন, ইউপি নির্বাচনে নৌকা দিয়ে মনোনয়ন–বাণিজ্য, ইউপি নির্বাচনে কালকিনিতে নৌকার ভরাডুবি, নির্বাচনী এলাকায় দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকা, যুক্তরাষ্ট্রে ফ্ল্যাট কেনার অভিযোগ, নির্বাচনী এলাকায় একাধিক মানুষের জমি দখলসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকায় আবদুস সোবহান মিয়ার পরাজয় হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ

টানা তৃতীয়বারের মতো হেরেছেন আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ। ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমানের (নিক্সন চৌধুরী) কাছে টানা তৃতীয়বারের মতো হেরেছেন নৌকার প্রার্থী কাজী জাফর উল্যাহ। কাজী জাফর উল্যাহ এলাকায় থেকেও জনবিচ্ছিন্ন থাকতেন। করোনার সময় দীর্ঘদিন তিনি এলাকায় আসেননি। জনগণের সঙ্গে সহজে মিশতে পারেন না। এ কারণে তিনি এলাকাবাসীর কাছে নিকটজন হতে পারেননি।

হাসানুল হক ইনুফাইল ছবি

সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও কুষ্টিয়া-২ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু হেরে যাওয়ায় অবাক হয়েছেন অনেকেই। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নানা কারণে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছে, দূরত্ব বেড়েছে। তাঁর হারের পেছনে আওয়ামী লীগের একজন নেতার কৌশল কাজ করেছে। এ ছাড়া অর্থের প্রভাবও রয়েছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ইতিমধ্যে সাংবাদিকদের বলেছেন, হাসানুল হক ইনু নির্বাচনে হেরে গেলেও এর প্রভাব ১৪–দলীয় জোটে পড়বে না। বিষয়টি এখন স্পষ্ট।

মেহের আফরোজ চুমকি l

বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি গাজীপুর-৫ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য থাকার পর এবার হেরে গেছেন। মেহের আফরোজ চুমকি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ কম ছিল। তাঁদের ঠিকমতো খোঁজখবর নেননি। এ কারণে তাঁদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া এলাকায় যে পরিমাণ উন্নয়ন হওয়ার কথা, সেটি হয়নি। নাগরী এলাকায় খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ বসবাস করেন, তাঁদেরও তেমন খোঁজখবর রাখেনি। সেটির প্রভাব পড়েছে ভোটের মাঠে। বাড়িয়া ইউনিয়নের অধিকাংশ রাস্তা এখনো কাঁচা। তিনি এলাকায় কম সময় দিতেন।

মসিউর রহমান রাঙ্গা
মসিউর রহমান রাঙ্গা

রংপুর-১ আসনের জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান (রাঙ্গা) পরাজিত হয়েছেন। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, রংপুর-১ আসনের গঙ্গাচড়ার লোকজনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল না। তাঁর পরিবহন ব্যবসা থাকলেও মানুষ তাঁদের প্রয়োজনে পাশে পাননি এই সংসদ সদস্যকে। পাশাপাশি বিভিন্ন কাজ ও চাকরি দেওয়ার কথা বলে টাকা নিতেন, এ কারণে মানুষজন বিরক্ত ছিলেন। সরকারের একটি সংস্থা তাঁকে জয়ী করতে চেষ্টা করলেও প্রশাসনের চাপে তা পারেনি।

সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই ও শাল্লা) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের ছোট ভাই চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ হেরেছেন। তবে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, এ আসনে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে, এমনটা দেখানোর জন্যই আইজিপির ভাইকে চাপে রাখা হয় এবং তাঁকে হারানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর স্ত্রী স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য জয়া সেনগুপ্তা এ আসনে জয়ী হয়েছেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনে ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) সৈয়দ নুরুল ইসলামের ভাই শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামও হেরেছেন। পুলিশের পোশাক পরা ছোট ভাই ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ফরম নেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগে সমালোচনা হয়। এই নির্বাচন ও আগের উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের সময় পুলিশ কর্মকর্তা ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়েছেন বলে এলাকায় আলোচনা রয়েছে। এবার ভাইয়ের প্রভাব নৌকার ভোটাররা পছন্দ করেননি। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য কানসাট বিদ্যুৎ আন্দোলনের নেতা গোলাম রাব্বানীও নির্বাচনে অংশ নিয়ে ২২ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছেন। এগুলোই নজরুল ইসলামের পরাজয়ের কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বরিশাল মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হামিদুল আলমের স্ত্রী স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহাজাদী আলম ওরফে লিপি বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনে পরাজিত হয়েছেন। হামিদুল সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে স্ত্রীর নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়ায় তাঁকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কয়েকজন ভোটারের ভাষ্যমতে, ভোটের মাত্র দুই দিন আগে বরখাস্ত হওয়ায় নির্বাচনে প্রভাব পড়ে। অতিরিক্ত ডিআইজিকে ভোটের দিন এলাকায় দেখা যায়নি। কর্মীরাও কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। এ কারণে ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে নিয়ন্ত্রণ ছিল নৌকার কর্মীদের।

আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভী
আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভী ফাইল ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে দুবারের সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নদভী আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মোতালেবের কাছে হেরেছেন। জামায়াত নেতা প্রয়াত মুমিনুল হকের জামাতা নদভীর সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক সুদৃঢ় ছিল। সাতকানিয়ার বাসিন্দা জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আ ন ম শামসুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। কিন্তু কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক ইসলামি ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য পদ থেকে তাঁকে বাদ দেন চেয়ারম্যান নদভী। এ ছাড়া গত পাঁচ বছরে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় বিএনপি–জামায়াতের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা–হামলার অভিযোগও রয়েছে নদভীর বিরুদ্ধে। তাই বিএনপি–জামায়াতের সমর্থন তিনি পাননি। অন্যদিকে আবদুল মোতালেবের ভাই মাহমুদুল হক জামায়াতের রুকন। তিনি নিজে বড় ভাইয়ের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। জামায়াত–বিএনপি সমর্থক কিছু ভোট মোতালেব পেয়েছেন।

অসীম কুমার উকিল
অসীম কুমার উকিল

নেত্রকোনা-৩ (কেন্দুয়া-আটপাড়া) আসনে সংসদ সদস্য অসীম কুমার উকিল হেরেছেন। স্থানীয় মানুষের মতে, অসীম কুমার উকিল কেন্দ্রীয় নেতা হতে পারেন, কিন্তু তৃণমূলের মানুষের সঙ্গে তিনি সহজে মিশতেন না। সংসদ সদস্য থাকাকালে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সীমিত যোগাযোগ ছিল। তিনি সময় পেলে এলাকায় আসতেন ঠিকই, কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা করতেন না। কেন্দুয়া উপজেলার সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র আসাদুল হক ভূঁইয়াসহ কয়েকজন নেতাকে নিয়ে তিনি থাকতেন। এ কারণে অনেক ভোটারই ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে ভোট দেননি।

মুন্সিগঞ্জ-৩ (মুন্সিগঞ্জ সদর-গজারিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাস হেরেছেন। এই আসনে পরপর দুবার সংসদ সদস্য ছিলেন মৃণাল কান্তি দাস। তিনি দুবারই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সহযোগিতায় নির্বাচিত হন। তবে নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের মূল দলের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে তিনি সুসম্পর্ক ধরে রাখতে পারেননি। দলীয় কর্মসূচিতেও তিনি মূল দলের নেতা-কর্মীদের ডাকতেন না, খোঁজখবর নিতেন না, সাহায্য করতেন না। এ কারণে নেতা-কর্মীরা তাঁর থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন।

যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আজিজুল ইসলামের কাছে হেরেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী শাহীন চাকলাদার। তিনি বর্তমান সংসদ সদস্য ও যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। জনবিচ্ছিন্নতার কারণেই তিনি হেরেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।

ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বরগুনা-১ আসনে সাতবার দলীয় মনোনয়ন পান। এর মধ্যে ২০০১ ও সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যান। তিনি টানা ৩০ বছর বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ আঁকড়ে আছেন। ২০০৮ সাল থেকে টানা তিনবার সংসদ সদস্য থাকলেও এলাকার উন্নয়নের ব্যাপারে তিনি ছিলেন উদাসীন। একই সঙ্গে দলের উদীয়মান ও তরুণ নেতৃত্বকে কোণঠাসা করে নিজের আত্মীয় ও অন্য দলের লোকজনকে দলীয় পদে বসিয়ে একটি নিজস্ব গোষ্ঠী সৃষ্টি করেন। একই সঙ্গে নানা সরকারি প্রকল্পে ঘুষ-দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এ নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে চরম ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবারের নির্বাচনে। তিনি দলের তরুণ নেতা ও সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম সরোয়ারের কাছে হেরে যান। এবার তিনি তৃতীয় হন। দ্বিতীয় হয়েছেন দলের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম ছরোয়ার।

ঢাকা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য সানজিদা খানম হেরে গেছেন। তিনি অনেকটা নির্ভার ছিলেন। তাঁরও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ছিল। লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে এই আসনে লড়েছেন গত দুবারের সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। তিনিও হেরেছেন। শ্যামপুর-কদমতলী এলাকার এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সহকারী একান্ত সচিব আওলাদ হোসেন জয়ী হয়েছেন।

রাজশাহী-৪ আসনে এনামুল হক হেরেছেন। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (লাল পতাকা) চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী অঞ্চলের নেতা আবদুর রাজ্জাক ওরফে আর্ট বাবুর নেতৃত্বে শতাধিক চরমপন্থী রাজশাহীর সংসদ সদস্য এনামুল হকের হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগ ওঠে।

পিরোজপুর-২ আসন থেকে ছয়বার সংসদ সদস্য হয়েছেন জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। এবারও ভাগে পান এই আসন। তাঁরই একসময়ের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মো. মহিউদ্দীন ওরফে মহারাজ স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। এপিএস থাকার কারণে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর রাজনৈতিক বিষয়গুলো দেখভাল করতেন। পরবর্তী সময়ে এদের বেশির ভাগের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। স্থানীয় লোকজনের মতে, মহারাজ অনেক অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। তিনি অনেক টাকাপয়সা খরচ করেছেন।

মাহী বি চৌধুরী
মাহী বি চৌধুরী

এদিকে মাহী বি. চৌধুরীর জামানত হারানোর বিষয়টি সবাইকে হতবাক করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, রাজনীতিতে চৌধুরী পরিবারের ঐতিহ্য রয়েছে। মাহীর দাদা কফিলউদ্দিন চৌধুরী দুবার, সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী পাঁচবার এবং মাহী বি চৌধুরী তিনবার নির্বাচিত হয়েছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটের পক্ষে নৌকা প্রতীক নিয়ে মাহী বি চৌধুরী সর্বশেষ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবার দলীয় প্রতীক কুলার ভরাডুবির অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে মাহী বি চৌধুরীর সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকে এলাকায় বেশির ভাগ সময় অনুপস্থিত থাকা ও বিকল্পধারাকে সুসংগঠিত করতে না পারাকে।

এবারের নির্বাচনে কম আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। কিন্তু অনেক ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থী হেরেছেন ভিন্ন ভিন্ন কারণে। এর মধ্যে রয়েছে গণবিচ্ছিন্নতা এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের মতো কারণও রয়েছে। আবার প্রশাসনও তাঁদের জিতিয়ে আনতে উদ্যোগ নেয়নি।

Link to original story