কেমন আছেন কুমুদিনী হাজং

নেত্রকোনার দুর্গাপুরের কুল্লাগুড়া ইউনিয়নের বহেরাতলী গ্রাম। এই গ্রামের একটি গারো পাহাড়ে দেখা মিলল এক বৃদ্ধার। বাড়ির বারান্দার ধুলোমাখা মেঝেতে শুয়ে ছিলেন। চুলগুলো উস্কো-খুস্কো, হাত-পা খসখসে। শরীরে যেন কতদিন সাবান-তেল পড়েনি। দেখে মনে হলো, তাকে যত্নআত্মি করার বা ওষুধপথ্য দেওয়ার কেউ নেই। পরনের কাপড়ও ধুলো-ময়লায় একাকার।

বলছিলাম ব্রিটিশ শাসনামলের ঐতিহাসিক টংক ও হাজং বিদ্রোহের জীবন্ত কিংবদন্তি কুমুদিনী হাজংয়ের কথা। ১২ বছর বয়সে স্বামীর সঙ্গে তিনি টংক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ডাক দিতেই চোখ মেলে তাকালেন। এরপর দুর্বল শরীরে ধীরে উঠে বসলেন। বললেন, জ্বর হয়েছিল। জ্বরে ভুগে দুর্বল হয়ে গেছি। কানে শুনি না, চোখে দেখি না। ৯৫ বছর বয়সের দ্বারপ্রান্তে এসে নানা অসুখ শরীরে বাসা বেঁধেছে তার।

তিন ছেলের মধ্যে কুমুদিনী হাজংয়ের সঙ্গে থাকেন মেজো ছেলে অর্জুন হাজং ও তার পরিবার। গারো পাহাড়ে ২ একর ২ শতাংশ জমি নিয়ে তার বাড়ি। সম্প্রতি তাকে দুকক্ষবিশিষ্ট পাকা ঘর উপহার দিয়েছে দুর্যোগ  ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। সে ঘরে থাকেন ছেলে, তার বউ ও নাতি-নাতনিরা। আগে একটি টিনের ঘর তুলে দিয়েছিলেন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তাসমিমা হোসেন। কুমুদিনী হাজং থাকেন সেই ঘরে। এই বয়সে এসেও নিজের কাজগুলো নিজেই করেন। ডোবায় গিয়ে গোসল করেন। প্রতিদিনের কাজগুলো সারেন। ছেলে অর্জুন হাজং জানালেন, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-নামতে কষ্ট হয়। তাই পুরোনো ঘরেই থাকেন মা।

এই গ্রামে ৫ কাঠা জমিও আছে কুমুদিনী হাজংয়ের। ছেলে আর তার বউ চাষ করেন। প্রতি মাসে উপজেলা প্রশাসন থেকে এক বস্তা চাল, ডাল, তেল, চিনি, লবণ, ডিম, ফল, শাড়ি, কম্বল দেওয়া হয়। এর বাইরেও ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সহযোগিতা করেন কেউ কেউ। সরকার থেকে পান বয়স্ক ভাতাও।

সময়টা ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল। টংক প্রথার কারণে খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছিলেন হাজং সম্প্রদায়ের কৃষকরা। জমিদার পরিবারের সন্তান হয়েও এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মনি সিংহ। তার নেতৃত্বে নানা দাবিতে চলছিল টংক আন্দোলন।

সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কুমোদিনী হাজং বলেন, অনেক কিছু ভুলে গেছি। কিন্তু কমরেড মনি সিংহের কথা আজও মনে আছে। আমার স্বামী লংকেশ্বর হাজং ও তার তিন ভাই টংক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিয়ের পর আমিও তাদের সঙ্গে যুক্ত হই। আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাই। এ কারণে জমিদার ও ব্রিটিশ বাহিনীর নজর পড়ে আমার স্বামী ও তার ভাইদের ওপর। এ সময় সুসং দুর্গাপুর হাই স্কুল মাঠে দ্বিতীয় পর্যায়ে টংক প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলনের প্রস্তুতি সভা হয়েছিল। এর পরই ১৯৪৬ সালের ১ জানুয়ারি দুর্গাপুর থানার বিরিশিরিতে এক ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনী। সেখান থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে আন্দোলনকারীদের দমনে চেষ্টা চলতে থাকে।

কুমুদিনী হাজং আরও বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল আমাদের বাড়িতে হানা দিয়েছিল। খবর পেয়ে আমার স্বামী ভাইদের নিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। তাদের ধরতে না পেরে সেনারা ক্ষেপে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। এক পর্যায়ে আমার কাছে জানতে চায়, লঙ্কেশ্বর হাজং কোথায় আছে? আমি বলি, ‘জানি না।’ তারা আমাকে বিরিশিরি সেনা ছাউনিতে ধরে নিয়ে যেতে চায়। সেদিন আমাকে ছাড়িয়ে নিতে শতাধিক হাজং নারী-পুরুষ তাদের পথরোধ করেছিল। সেনারা তাদের কথা না শুনে আমাকে নিয়ে রওনা দেয়। রাশিমনি নামে এক হাজং নারীর নেতৃত্বে দিস্তামনি হাজং, বাসন্তী হাজংসহ ১২ নারীর একটি সশস্ত্র দল আমাকে ছাড়িয়ে নিতে তাদের পথরোধ করে। সেনারা তাদের ওপর গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই মারা যান রাশিমনি হাজং। তাকে ধরতে গেলে পুরুষ দলের নেতা সুরেন্দ্র হাজংকেও হত্যা করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সেনাদের ওপর বল্লম ও রামদা দিয়ে হামলা চালায় হাজংরা। দুই সেনা সেখানেই নিহত হয়। বাকিরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। আমার সম্মান বাঁচাতে সেদিন দুজন মানুষ জীবন দিয়েছিলেন। সেদিনই শপথ নিয়েছিলাম, টংক আন্দোলনে অংশ নিয়ে ব্রিটিশদের এ দেশ থেকে তাড়াব।

কুমুদিনী হাজংয়ের সংগ্রামের সেই গল্প শুনতে শুনতে সময় গড়িয়ে যায়।

টংক আন্দোলনের এই নেত্রী এখন কেমন আছেন, জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাজিব উল আহসান বলেন, গ্রাম পুলিশের মাধ্যমে নিয়মিত ওনার খোঁজখবর রাখা হয়। অসুস্থতার খবর পেলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। তিন মাস পরপর আমি নিজেও তাকে দেখে আসি।