বছরে ১৩ হাজার শিশুরমৃত্যু পানিতে ডুবে

অন্য আর দশটা গ্রামের মতোই পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ১০ নম্বর বালিয়াতলীর কোম্পানিপাড়া। তবে এ গ্রামের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। এ গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই বসতঘর থেকে পুকুরের দূরত্ব ১০ থেকে ২০ গজ। পুকুরের চারদিকে কোনো বেড়া নেই। শান বাঁধানো ঘাটও নেই। পুকুরে নামার জায়গাটিও পিচ্ছিল গর্তের মতো। ভরদুপুরে শিশুরা সেই পুকুরে গোসল করে। তাদের সঙ্গে থাকেন না কোনো অভিভাবক।

জানা যায়, গত বছর পানিতে পড়া শিশু মৃত্যুতে বরিশাল রয়েছে চতুর্থ স্থানে। বছরের ১৩১ শিশু সেখানে পানিতে ডুবে মারা গেছে।

গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় সমষ্টি জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম এবং নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানা যায়।

জিএইচএআইয়ের তথ্যমতে, দেশে ৮০ শতাংশ শিশুর মৃত্যু ঘটে বাড়ি থেকে ২০ গজ দূরে পুকুর, ডোবা বা নালার পানিতে পড়ে। প্রায় প্রতিদিন সব বয়সী ৫০ জন, ১৮ বছরের নিচে ৪০ জন, ৫ বছরের নিচে প্রায় ৩০ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এভাবে বছরে প্রায় ১৩ হাজার শিশু মারা যায়।

বসতঘর থেকে প্রায় ১০ গজ দূরের পুকুরে পড়ে মারা গিয়েছিল সাড়ে চার বছরের ইয়াসিন। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ১০ নম্বর বালিয়াতলীর কোম্পানিপাড়া গ্রামে বছর দুয়েক আগে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছিল। আঁচল শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থেকে দুপুর ১টায় বাড়ি ফিরে নাশতা খেয়ে মায়ের কাছে বায়না করেছিল শাক দিয়ে ভাত খাওয়ার। কিন্তু শাক দিয়ে তার আর ভাত খাওয়া হয়ে ওঠেনি। মা কোহিনুর বেগম ছেলের শাক খাওয়ার ইচ্ছে আজও ভোলেননি। পুকুরে গোসল করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি তার আদরের সন্তান। সন্তানের কথা ভেবে এখনো নিভৃতে কাঁদেন মা।

তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘রান্না করছিলাম। মেজো ছেলেকে মাদ্রাসা থেকে বাড়ি ফিরতে দেখে খোঁজ করি ইয়াসিন কই? ও বলে ইয়াসিন তো পুকুরপাড়ে নাই। এ কথা শুনে দৌড়ে পাকঘর থেকে বেরিয়ে পাড়ে গিয়ে দেখি জুতা ও মগ আছে, ছেলে নাই। ছেলেকে খুঁজতে পুকুরে নামি। আমার স্বামী কইলো, তোমার বইনের বাড়ি মুড়ি ভাজতাছে, সেইখানে গিয়া দেখো। আমার ছেলে মুড়ি খেতে ভালোবাসত। ওই বাড়িতে গিয়া দেখি ইয়াসিন সেখানেও নাই। দৌড়ে এসে বলতেই আমার স্বামী পুকুরে নাইম্যা পানির নিচে গিয়া দেখে ইয়াসিন উপুড় হইয়্যা রইছে। প্রায় ১০ মিনিটের মতো পানির নিচে ছিল। পানি থিক্যা ছেলেরে টাইন্যা তুলি। আমরা  জানতাম না এরপর কী করতে হইব? জ্ঞান ফেরানোর জন্য ঝুলাই, শরীরে কম্বল পেঁচাই। হাসপাতালে নিলে ডাক্তাররা বলেন, রোগী নাই। এরপর লাশ তদন্ত ছাড়াই দাফন করি।’

জিএইচএআইয়ের তথ্যে, দেশে ২০২২ সালে পানিতে ডুবে ৯ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার বেড়েছে। এ সময় পানিতে ডুবে মৃতদের মধ্যে ৮১ শতাংশের বয়স ছিল ৯ বছরের কম। আগের বছরের তুলনায় এ হার ৮ শতাংশ বেশি। এসব শিশুর ৬১ শতাংশ তাদের চতুর্থ জন্মদিনের আগেই মারা গেছে।

গত ১২ মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত পানিতে ডুবে ১ হাজার ১৩০টি মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, ২০২০ ও ২০২১ সালে ৯ বছর বয়সীদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার ছিল যথাক্রমে ৬৫ ও ৭৩ শতাংশ। এ দুই বছরে পানিতে ডুবে ৮০৭ ও ১ হাজার ৩৪৭টি মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে।

২০২২ সালে পানিতে ডুবে মৃতদের ৯৪ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এর মধ্যে চার বছর বা কম বয়সী ৫৫৬ জন, ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী ৩৬৩ জন, ১০ থেকে ১৪ বছরের ১০২ এবং ১৫ থেকে ১৮ বছরের ৪৩ জন। ৬৬ জনের বয়স ছিল ১৮ বছরের বেশি।

বরিশালের সিআইপিআরবির ফিল্ড টিম ম্যানেজার মোহাম্মদ মোতাহের হুসাইন বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শিশুদের মায়েরা গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত থাকেন। সপ্তাহে ছয় দিন আঁচল শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশের মাধ্যমে শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, ভাষাগত, মানসিক ও সামাজিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা হয়। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় একটি আঁচল (সমন্বিত শিশু বিকাশ ও দিবাযত্ন কেন্দ্র) রয়েছে, যেখানে শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ, পানিতে ডোবা শিশুকে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সমষ্টির পরিচালক মীর মাসরুর জামানের মতে, একটি প্রকল্প প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির ধারণা দিতে পারে। এ সচেতনতাকে গার্হস্থ্য জীবনে কাজে লাগিয়ে এর ধারাবাহিকতাকে ধরে রাখতে হবে। ব্যক্তি ও সামাজিক পুকুরগুলোতে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে হবে। পানি থেকে তোলার পর শিশুকে প্রাথমিক চিকিৎসা কীভাবে দিতে হয়, সে সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।

শিশুদের দেখে রাখতে হবে যেন তারা পার্শ্ববর্তী পুকুর বা জলাশয়ের কাছে না যায়। এ দুর্ঘটনা রোধে ৬ থেকে ১০ বছরের মধ্যে প্রত্যেক শিশুকে সাঁতার শেখাতে হবে। দেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে দরকার সচেতনতা। প্রাক-স্কুলের শিশুদের জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সুবিধা নিশ্চিত করা। শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সাঁতারে দক্ষ করে তোলা। জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও বিনিয়োগ এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে।