সদিচ্ছাই প্রেরণা জোগায়

কয়েক বছর আগেও দলিত সম্প্রদায়ের মেয়েরা নিজের অধিকার, ইচ্ছার কথা বলার সাহস পেত না। সব ধরনের অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত ছিল। সুইপারের কাজ করে টাকা রোজগার করলেও নিজের প্রয়োজনে খরচ করার অধিকার ছিল না। স্বামী তাদের রোজগারের টাকা দিয়ে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরত। এরপর বৌকে পেটাত। মেয়ের নিজের পছন্দ করে বিয়ে করার কথা বলার অধিকার ছিল না।

মনি রানী দাস এ নারীদের জীবনমান বদলাতে দলিত নারী ফোরাম নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এখন এ সংগঠনের সংখ্যা ১১টি। এ সংগঠনের মাধ্যমে তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করছেন। দলিত সম্প্রদায়ের মেয়েরা ঘর থেকে বেরিয়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। নিজের অধিকারের কথা বলতে পারছে।

এভাবেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে দলিত নারীদের ঘর থেকে বের করে আনার প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন মনি রানী দাস। তিনি বলেন, নারী-পুরুষ সমান অধিকার। এ অধিকার থেকে নারী কেন বঞ্চিত থাকবে। তারা কেন সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে না। এ ভাবনা থেকেই দলিত নারী অর্থাৎ পিছিয়ে পড়া নারীদের সামাজিক উন্নয়নে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই।

মনি রানী দাসের জন্ম, বেড়ে ওঠা রাজধানীর হাজারীবাগের গণকটুলী সুইপার কলোনিতে। তার পূর্বপুরুষরা বাংলাদেশে এসেছেন ভারতের বিলাসপুর থেকে। ব্রিটিশরা সুইপারের চাকরি দিয়ে তাদের এখানে নিয়ে আসে। বাড়িতে তারা হিন্দিতে কথা বলতেন। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মনি রানী দাস ছোট। বাবা-মা দুজনই তাদের ভাইবোনদের অনেক যত্ন করে গড়ে তুলেছেন। তারা চাইতেন ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াক। দলিত সমাজে জন্ম হওয়ার কারণে তারা যাতে পিছিয়ে না পড়ে। মনি রানী দাস পছন্দ করা পাত্রকে বিয়ে করেন। স্বামী রাম স্বরূপ এয়ারপোর্টে বিমানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চাকরি করেন। তাদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে।

হাজারীবাগ উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন মনি রানী দাস। কিন্তু সুইপারের মেয়ে বলে সহপাঠীদের কাছে উপহাসের পাত্রীও হয়েছেন। বাড়ি ফিরে বাবা চুন্নী লালকে বললে, বাবা তাকে বলতেন, ‘এসব কথা কানে দিও না। লেখাপড়া শিখে মানুষ হও।’

কিন্তু সহপাঠীদের উপহাস তাকে কষ্ট দিত। নিজ সম্প্রদায়ের মেয়েরা যাতে ঘর থেকে বের হয়ে নিজের পরিচয় গড়ে তোলে, তাদের অবস্থার পরিবর্তন করে এ নিয়ে তিনি ভাবতেন। তাই ছেলেবেলায় লেখাপড়ার পাশাপাশি মামা হরিচরণ দাসের উৎসাহে মুকুল ফৌজে যোগ দেন। মুকুল ফৌজে যুক্ত হয়ে অনেক মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয় তার। তার কাছ থেকে অনেক কিছু জানার সুযোগ পান। নিজের জানাকে কাজে লাগিয়ে নিজ সমাজের মানুষরা এতদিন ধরে যে কুসংস্কারগুলো লালন করে আসছিল, তা নিরসনে উদ্যোগ নেন।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে মনি রানী দাস দলিত সমাজের উন্নয়নে ২০০৬ সালে দলিত নারী ফোরাম নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। তিনি পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তাদের অবস্থান পরিবর্তন কীভাবে করা যায় এ নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। তিনি আরও বলেন, ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে ‘দলিত’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয়। ২০১১ সালে জাতীয় বাজেটে দলিতদের জন্য ১০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। দলিত সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ২০১৮ সালে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়নের জন্য আবেদন করি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নারী-পুরুষের সমান অধিকার। এ অধিকার থেকে আমরা দলিত নারীরা কেন বঞ্চিত থাকব। আমাদের মেয়েরা কেন সব অধিকার পাচ্ছে না। বিভিন্ন কনফারেন্সে অংশ নিয়ে ভারতের দিল্লিতে দুবার, গুজরাটে দুবার, নেপালে ১৬-১৭ বার, লন্ডন, সুইজারল্যান্ড, জাপান গিয়েছি। মাইনরটি ফোরামের পক্ষে দলিত নারীদের অবস্থান নিয়ে জেনেভায় হিউম্যান রাইটস প্রোগ্রামে বক্তৃতা দিয়েছি।

মনি রানী দলিত জনগোষ্ঠীর আট দফা দাবি উত্থাপন করেন। জাত-পাত ও পেশাভিত্তিক বৈষম্য প্রতিরোধে প্রস্তাবিত ‘বৈষম্য বিলোপ আইন’ দ্রুত প্রণয়ন, জাতীয় বাজেটে দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য সুনির্দিষ্টভাবে ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি’র বরাদ্দ বাড়ানো, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের পেশাগত স্বাস্থ্যঝুঁকি বিশেষ বিবেচনায় এনে তাদের সুরক্ষার সব উপকরণ সরবরাহ করা। সব ধরনের সরকারি চাকরিতে দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। জাতীয় সংসদে সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনে দলিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। সব মহানগরী ও পৌরসভায় দলিত জনগোষ্ঠীর সবার জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলিত শিক্ষার্থীদের ভর্তি কোটা প্রবর্তন করা। দলিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরেপড়া রোধকল্পে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ। এ জনগোষ্ঠীর ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া।