৭১ বছর পরও স্মৃতিতে জ্বলজ্বল ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি

প্রতিভা মুৎসুদ্দি থাকেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কুমুদিনীর কোয়ার্টারে। একজন সিস্টার তার দেখাশোনা করছেন। এ বয়সেও রুটিনমাফিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত তিনি। সকাল ৬টায় ঘুম থেকে ওঠেন, প্রাত্যহিক কাজ সেরে চা-জলখাবার খেয়ে ঘণ্টাখানেক হাঁটেন। এরপর একটু বিশ্রাম নিয়ে পত্রিকা-বই পড়েন। টেলিভিশন দেখেন। সকাল ১০টায় ফল খান। দুপুর ১২টার দিকে ওষুধ খান। এরপর ঘণ্টাখানেক বারান্দায় বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করেন। ১টার দিকে স্নান সেরে প্রার্থনার পর দুপুরের খাবার, ওষুধ খেয়ে বিশ্রাম নেন। বিকেল ৫টায় চা-জলখাবার খেতে খেতে টেলিভিশন দেখেন। রাত ৮টার দিকে ফোনে সবার খবরাখবর নেন। ৯টার দিকে রাতের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ পর ঘুমুতে যাচ্ছেন।

কেমন আছেন বলতেই প্রতিভা মুৎসুদ্দি বললেন, শরীর তেমন ভালো না। বছরখানেক আগে পড়ে গিয়ে ডান হাতে আঘাত পেয়েছিলাম। এখনো মাঝেমধ্যে ব্যথা করে। কানেও কম শুনি।

প্রতিভা মুৎসুদ্দি একজন শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ এবং কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্টের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে তার অবদান অনেক। ছাত্রজীবনে তিনি যেমন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে দেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন, মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে নেমে কারাবরণ করেছেন, তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রকেও নকলমুক্ত করার জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নিলেও শিক্ষাক্ষেত্র থেকে তিনি সরে দাঁড়াননি। বরং ভারতেশ্বরী হোমসসহ কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ, কুমুদিনী হাসপাতাল স্কুল অব নাসিংয়ের কর্মকাণ্ডে এখনো সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন।

ভাষাসৈনিক প্রতিভা মুৎসুদ্দির জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর। চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার মহামুনি পাহাড়তলী গ্রামে। বাবা কিরণ বিকাশ মুৎসুদ্দি ছিলেন আইনজীবী। মা শৈলবালা মুৎসুদ্দি ছিলেন গৃহিণী। ১৯৪৮ সালে তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। ৩০ জানুয়ারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা মহাত্মা গান্ধী নিহত হলে অন্যায়ের প্রতিবাদে সভা, মিছিল করেন। কাঙালিভোজ দেন। এ বছরই মে মাসে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার কৃষকদের অধিকার আদায়ের বিরোধিতা করে কৃষক হত্যা করে। ঘটনাটি ছিল চট্টগ্রামের মাদারশায় খাল কাটা নিয়ে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন কৃষক নিহত হন। ওইদিন প্রতিভা অসুস্থতার কারণে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে পারেননি। তার ছোট বোন ছিলেন এ বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। বিদ্যালয়ে এসে কৃষক হত্যার সংবাদ শোনামাত্র ছোট বোন দ্রুত বাড়ি ফিরে পুরো ঘটনাটা প্রতিভাকে জানান। ছোট বোনের মুখে এ হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে তিনি দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিদ্যালয়ে চলে এলেন। কৃষক হত্যার প্রতিবাদে ছেলেমেয়েদের ক্লাস বর্জন করে মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য বেরিয়ে আসতে অনুরোধ করেন। শিক্ষকরা স্কুল থেকে মিছিল বের করতে দেবেন না। মিছিল বন্ধ করার জন্য ছেলেদের ক্লাসে ঢুকিয়ে দেন। এতে এতটুকু দমলেন না প্রতিভা। বরং তিনি মুখে চোঙা লাগিয়ে ছেলেদের ক্লাস বর্জন করে বাইরে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান। শিক্ষকরা তার এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ মেনে নিতে পারলেন না। সঙ্গে সঙ্গে প্রধান শিক্ষক তার জেঠামশায় হৃদয় মুৎসুদ্দিকে ডেকে ঘটনাটি জানান। এও জানান, তিনি প্রতিভাকে এ বিদ্যালয়ে রাখবেন না। জেঠামশায় তার বাবাকে ঘটনাটি জানালে মেয়ের দুঃসাহসিকতা দেখে ভীষণ ক্ষেপে যান।

‘উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’—মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এ অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা রোষে ফেটে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। চট্টগ্রামেও মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম কমিটি গড়ে ওঠে।

প্রতিভা মুৎসুদ্দি বলেন, ১৯৫২ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আমি। ভাষার দাবিতে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নিই। অন্যান্য স্কুলের ছাত্রছাত্রী নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে মিছিল, সভা, স্লোগান করি। পোস্টার লিখি। বাবা কখনোই চাইতেন না আমি রাজনীতিতে জড়াই। অভিভাবকদের বাধাকে উপেক্ষা করে মাতৃভাষার দাবিতে রাজপথে নেমে মিছিল, সভা, স্লোগানে অংশ নিই। চট্টগ্রাম রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়ক মাহবুব উল আলম চৌধুরীর আহ্বানে ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে ধর্মঘট পালন, মিছিল ও সভায় যোগ দিই। ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের জন্য আগের দিন সারা রাত জেগে পোস্টার লিখি। ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বিকেলে শিক্ষার্থীদের এক বিরাট মিছিল নিয়ে ডা. খাস্তগীর স্কুলে যাই। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে ঢাকার ছাত্রদের ওপর পুলিশি জুলুমের কথা এবং ছাত্র হত্যার কথা মেয়েদের অবগত করি। সেখান থেকে ট্রাকে করে মেয়েদের মিছিল নিয়ে চট্টগ্রামের সারা শহর প্রদক্ষিণ করি। আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় বিভিন্ন নারী সংগঠন। চট্টগ্রামের সর্বদলীয় কর্মপরিষদের হয়ে সেদিন রাজপথে নামেন শেলী দস্তিদার, প্রণতি দস্তিদার (পূর্ণেন্দু দস্তিদারের বোন), মীরাসহ সিনিয়র শিক্ষার্থী সুলেখা, মিনতি, রামেন্দ্র, সুচরিত চৌধুরীসহ আরও অনেকে।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টকে জয়যুক্ত করার আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় অংশ নেন। ১৯৫৫ সালে মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পর সভা-মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সাবসিডিয়ারি পরীক্ষা চলছে। তাই ২১ ফেব্রুয়ারির সভায় যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। এদিকে সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪৪ ধারা জারি করেছে। কিন্তু হঠাৎ সকাল ১১টার দিকে খবর পান মিটফোর্ড ও মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অপরাধে গ্রেপ্তার ছাত্রীদের মুক্তির দাবিতে প্রতিভা মুৎসুদ্দি কামরুন নাহার লাইলী, রওশন আরাসহ আরও ৮-১০ জনের একটি দল নিয়ে উইমেন্স হল থেকে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সারিবদ্ধ মিলিটারির ভেতর দিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের আমতলায় সমবেত হন। হঠাৎ পুলিশের লাঠিচার্জে ছাত্রছাত্রীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। প্রতিভা নিজেও লাঠির আঘাতে আহত হন। তারা প্রথমে কমনরুমে পরে গ্রন্থাগারে গিয়ে আশ্রয় নেন। সন্ধ্যা হয়ে গেলে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন, একা বের না হয়ে একসঙ্গে বের হবেন। তারা বের হলে ওই সময় যত ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে লুকিয়ে ছিল তারা বের হয়ে আসেন। পুলিশ প্রায় কয়েকশ ছাত্রছাত্রীকে লালবাগ থানায় নিয়ে যায়। প্রতিভাকেও তাদের সঙ্গে

পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।