একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, গোবরা মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী

This story first appeared in kalbela.com

রাজনীতির আকাশের এক অনন্য নক্ষত্র চলে গেলেন না ফেরার দেশে। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক, জাতীয় সংসদ উপনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী গতকাল রোববার রাত ১১টা ৪০ মিনিটে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের এমএনএ নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া সরকারের টালবাহানার কারণে তিনি আর সংসদে যাওয়ার সুযোগ পাননি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেসকোর্স ময়দানে ভাষণের পর পরই তিনি মেয়েদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে তার ইন্দিরা রোডের বাসায় ডামি রাইফেল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। অস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে ২৩ মার্চ মেয়েদের নিয়ে মার্চ করতে করতে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যান। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন একাত্তরে আওয়ামী লীগের ছাত্রনেত্রী ছিলেন । তিনি বাংলাদেশের পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের ২৬ মার্চ রাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি নির্দেশ তিনি অক্ষরে অক্ষরে মেনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে মাতৃভূমি রক্ষায় নিজ দায়িত্ব পালন করেন।

’৭০-এর সংরক্ষিত আসনের নির্বাচিত এমএনএ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে এমএনএ রাফিয়া আখতার ডলি দৈনিক কালবেলাকে বলেন, ‘একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। সে সময় সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর বাড়িতে একটি রাজনৈতিক বৈঠক চলছিল। এ বৈঠকে আমিও উপস্থিত ছিলাম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা টের পেয়ে ওই রাতে রোকেয়া হলের হোস্টেলে না ফিরে সেখানেই থেকে যাই। সকালে রাস্তায় বের হয়ে দেখি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতার দৃশ্য। ভারতে গিয়ে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিচালিত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ‘গোবরা মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প’-এর দেখাশোনার কাজেও সহযোগিতা করি। তখন তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে দেশের দুর্দিনে, দুঃসময়ে তিনি কীভাবে দৃঢ়তা-প্রজ্ঞা-সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন। কখনো মনোবল হারাননি। একাত্তরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কলকাতায় ‘গোবরা মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে’র পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। মেয়েদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। এই ক্যাম্পে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মেয়েরা এসেছিলেন।’
গোবরা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা মুকুল মজুমদার দৈনিক কালবেলাকে বলেন, ‘সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে আগরতলা থেকে সরাসরি কলকাতার গোবরা মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আসি। সেখানে প্রথম ৩০০ মেয়েকে দেখতে পাই। পরবর্তী সময়ে এই ক্যাম্পে ৪৫০ থেকে ৫০০ মেয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘গোবরা মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প তৈরির জন্য কলকাতার ৪৮/এ, মহেন্দ্র রায় লেনের এই বাড়িটি দেন মাদারীপুরের সুবিমল রায় নামে এক ব্যক্তি। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য কিছু করার তাড়না থেকে বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধের কাজে দিয়েছিলেন। এমএনএ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী থাকতেন কলকাতার পার্ক সার্কাসে। তিনি রোজ সকালে এসে আমাদের খোঁজ-খবর নিতেন কে কী খেলাম, কী করলাম, কীভাবে আছি। খুঁটিনাটি সব কিছুর খবরাখবর তিনি রাখতেন। তার নির্দেশে অনেককে আমি মুক্তিযুদ্ধে রিক্রুট করেছি। তিনি নিজে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দেখতেন। সম্ভবত একাত্তরের অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার থেকে মিতা ভদ্র নামে এক মেয়ে আমাদের ক্যাম্পে আসেন। পাকিস্তানি সেনারা ওর বাবাকে মেরে ফেলেছিল। ওর বাবা ডা. ভদ্র তাঁতীবাজারেই প্র্যাকটিস করতেন। মায়ের সঙ্গে মিতা ভদ্র সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। মিতা সাজেদা চৌধুরী বরাবর আবেদন করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য। তিনি ওই আবেদনের ওপর লিখে দিলেন, ‘মুকুল ওকে ভর্তি করে নাও।’ আমরা মেয়েটিকে আমাদের কেন্দ্রে ভর্তি করে নিয়েছিলাম। এরকমই সহজ-সরল সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার সঙ্গে আমাদের।’

মুক্তিযোদ্ধা শারাহ বানু শুচি ও তার বোন শিরিন বানু মিতিল দুজনই গোবরা মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ডা. শারাহ বানু শুচি দৈনিক কালবেলাকে বলেন, ‘জুলাই মাসে আগরতলা থেকে চলে এলাম কলকাতায়। কলকাতায় গোবরা ক্যাম্পে যোগ দিলাম। এখানে আমার বড় বোন শিরিন বানু মিতিলও ছিলেন। সবার একটাই কথা- আমাদের অস্ত্র দেন। আমরা যুদ্ধ করব। কিন্তু তখন ফার্স্ট এইড আর নার্সিংয়ের ট্রেনিংপ্রাপ্ত প্রশিক্ষিত নারী মুক্তিযোদ্ধারা আহত যোদ্ধাদের ফার্স্ট এইড দিতে যাচ্ছিলেন। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী প্রায়ই ক্যাম্পে আসতেন। মেয়েদের মুক্তিযুদ্ধে উজ্জীবিত করার জন্য তিনি বঙ্গবন্ধুর গল্প করতেন। বলতেন, ‘তোরা যুদ্ধে যেতে পারছিস না ,তাতে কী? যখন বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন, তখন সোনার দেশ হবে। ছেলেরাই তো সবাই অস্ত্র পাচ্ছে না। আমাদের যুদ্ধের কৌশল পাল্টাতে হবে।’ এভাবেই সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করার জন্য উজ্জীবিত করতেন।’

খুলনার মেয়ে মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণা রহমানও এই ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে তার হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি দৈনিক কালবেলাকে বলেন, ‘মেয়েদের উদ্দীপ্ত করার জন্য গোবরা ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী পালন করা হতো। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী কখনো কখনো অংশ নিতেন মেয়েদের উদ্দীপ্ত করতে।’

স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী দেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনে গুরুত্ব দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরে নির্যাতিত নারীদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে এ বোর্ডের পরিচালনার দায়িত্ব দেন। এ বোর্ডের অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মমতাজ বেগম, নূরজাহান মুরশিদ ও রাফিয়া আকতার ডলি। তিনি সবাইকে নিয়ে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ডে’র দায়িত্ব পালন করেন।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে সশস্ত্র শ্রদ্ধা জানাই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার সক্রিয় অবদান দেশ ও জাতি আজীবন মনে রাখবে।

Link to original story